শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৭:২৮ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
কীভাবে ঋণ জালিয়াতি, জানালেন উজ্জল

কীভাবে ঋণ জালিয়াতি, জানালেন উজ্জল

স্বদেশ ডেস্ক:

‘আমাকে ব্যবহার করে ঋণ জালিয়াতি করেছে প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ঋণ নেওয়া হলেও এর পুরো অর্থ রিলায়েন্স ফাইন্যান্সসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে নেন তিনি। প্রতিমাসে আমাকে ৫ লাখ টাকা বেতন দিতেন। তিনি আমাকে ব্যবহার করে এভাবে ঋণ জালিয়াতি করবেন তা তখন বুঝতে পারিনি। আমি আমার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত ও ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’ গত সোমবার এভাবেই আদালতে সরল স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন প্রায় ৭১ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ ও পাচারের মামলায় পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান উজ্জল কুমার নন্দী (৪০)। পিকে হালদারের সঙ্গে মিলেমিশে কীভাবে তিনি ঋণ জালিয়াতি করেছেন, তারও আদ্যোপান্ত জানিয়েছেন আদালতকে।

পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে গত সোমবার এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পিকে হালদারের সহযোগী উজ্জল কুমার নন্দীকে আদালতে হাজির করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদক উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান। এরপর স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তিনি। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট

আতিকুল ইসলাম ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন। এর পর আনান কেমিক্যাল লিমিটেডের পরিচালক উজ্জল কুমারকে কারাগারে পাঠানো হয়।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উজ্জল জানান, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে অ্যাকাউন্টিংয়ে ২০০৩ সালে অনার্স এবং ২০০৪ সালে এমবিএ পাস করার পর হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং-এর সিএ ফার্মে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট কোর্সে যোগদান করেন। ২০০৮ সালে আইআইডিএফসিতে চাকরিতে যোগ দেন এবং ২০১০ সালে গোল্ডেন ইন্স্যুরেন্সে সিএফও হিসেবে নিয়োগ পান। আইআইডিএফসিতে চাকরিকালে সেখানে ডিএমডি ছিলেন পিকে হালদার। মূলত সেখান থেকেই পিকে হালদারের সঙ্গে পরিচয়। ২০১৩ সালে গোল্ডেন ইন্স্যুরেন্সের চাকরি ছেড়ে নিজেই কনসালটেন্সি ফার্মের কাজ শুরু করেন উজ্জল। নতুন কাস্টমারের খোঁজে পিকে হালদারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি উজ্জলকে তার বিভিন্ন কোম্পানির কনসালটেন্সির কাজ করে দেওয়ার অফার দেন। পরে নর্দান জুট মিলস কেনার জন্য সরেজমিনে পিকে হালদারের সাথে নর্দান জুট মিলস পরিদর্শনে যান। মিল কেনার জন্য পিকে হালদার বেশ আগ্রহী হন এবং উজ্জলকে স্বাধীন পরিচালক হতে বলেন। তার কাছে কোনো টাকা না থাকায় পিকে হালদার তার সহযোগী রতন কুমার পালের সাথে উজ্জলের ঋণ অ্যাগ্রিমেন্ট দেখিয়ে নর্দান জুট মিলসের ৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকার শেয়ার তার নামে কেনেন। তিনি ছাড়াও অমিতাভ অধিকারী ওই কোম্পানির পরিচালক ছিলেন। পরে এ কোম্পানির নামে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ৩০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয় এবং উজ্জলকে নর্দান জুট মিলসের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। এ প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ঋণ নেওয়া হলেও ঋণের টাকা চলে যায় রিলায়েন্স ফাইন্যান্সসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে।

উজ্জল জবানবন্দিতে আরও জানান, তাকে আনান কেমিক্যাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেন পিকে হালদার। এ কোম্পানির নামে ঋণ নেওয়া হলেও ঋণের অর্থ অমিতাভ অধিকারীর সহায়তায় রিলায়েন্স ফাইন্যান্সসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে নেন পিকে হালদার। আনান কেমিক্যালের বর্তমান ঋণের দায় ৭০.৮২ কোটি টাকা। আনান কেমিক্যালের নামে ঋণ নেওয়া হলেও ঋণের ৫ কোটি টাকা ২০১৬ সালের ১৫ জুন ওয়াকামা লিমিটেডের আইএফআইসি ও ব্র্যাক ব্যাংকের হিসাবে, ওই বছরের ১৯ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক ব্যবহার করে ৯.৪০ কোটি টাকা ব্যাংক এশিয়া লিমিটেডের হাল ইন্টারন্যাশনাল লি. হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। পরে ওই হিসাব থেকে ৯.৪০ কোটি প্রশান্ত কুমার হালদারের হিসাবে সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর ২৩ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক ব্যবহার করে ১১.১৪ কোটি টাকা রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লি.র হিসাবে সরিয়ে নেওয়া হয়, যা দিয়ে দিয়া শিপিং লি.র নামে পরিচালিত ঋণ সমন্বয় করা হয়। ১৫ কোটি টাকা মেসার্স বর্র্ন, নিউট্রিক্যাল লি., আরবি এন্টারপ্রাইজের হিসাবে এবং ৭ কোটি টাকা সুখাদা লি.-এর হিসাবে সরিয়ে নেওয়া হয়। সবই ছিল পিকে হালদারের প্রতিষ্ঠান। উজ্জল ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে আনান কেমিক্যালের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।

জবানবন্দিতে তিনি আরও জানান, পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল লি.-এর চেয়ারম্যান ছিলেন উদ্দব মল্লিক ও সোমা ঘোষ। তাদের সময়ে এ প্রতিষ্ঠানের নামে ৬২.২০ কোটি টাকা ঋণ নেন, যার পুরো টাকাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের নামে ঋণ নেওয়া হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ৯টি চেক ব্যবহার করে এফএএস ফাইন্যান্স লি.-এর হিসাবে ২০১৬ সালের ২৯ জুন ৯.৩৩ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়। ওই দিনই বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি চেক ব্যবহার করে ১২.৪৩ কোটি টাকা রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লি.-এ সরিয়ে নেওয়া হয়। পরে ওই টাকা দিয়ে ‘এসএ এন্টারপ্রাইজ’-এর নামে পরিচালিত একটি ঋণ হিসাব সমন্বয় করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি চেক ব্যবহার করে ১০ কোটি টাকা ব্যাংক এশিয়া লি.-এ পরিচালিত ‘পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল’-এর হিসাবে সরিয়ে নেওয়া হয়। ওই বছরের ২৫ জুলাই ঋণের ৬ কোটি টাকা শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লি.র কারওয়ানবাজার শাখায় ‘পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল লি.’সহ বিভিন্ন নামে গৃহীত ঋণের অর্থ ব্যাংক এশিয়া লি.র ‘পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল লি’-এ স্থানান্তর করা হয়।

উজ্জল আরও জানান, তিনি রহমান কেমিক্যাল লি.র চেয়ারম্যান হওয়ার আগেই অমিতাভ অধিকারী, স্বপন কুমার মিস্ত্রি রহমান কেমিক্যাল লি. এমডি ও পরিচালক থাকা অবস্থায় ৫৪.৫৫ কোটি টাকা ঋণ নেন। যার পুরো টাকাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ১০টি চেকের মাধ্যমে বিভিন্ন তারিখে ঋণের অর্থের ৩৩ কোটি টাকা রহমান কেমিক্যালস লি.র নামে মার্কেন্টাইল ব্যাংক লি.র হিসাবে এবং এসআইবিএলের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। সেখান থেকে ব্যাংক এশিয়া লি.র ধানমন্ডি শাখায় পরিচালিত পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে সরিয়ে নেওয়া হয়। তিনটি চেকের মাধ্যমে ঋণের অর্থের ১২.৫০ কোটি টাকা ব্যাংক এশিয়া লি.র ধানমন্ডি শাখায় পরিচালিত ‘পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল’-এর হিসাবে সরিয়ে নেওয়া হয়। ২০১৭ সালের ২০ জুন অমিতাভ অধিকারী ও রাজীব সোমের পরিচালনাধীন ‘কেএইচবি সিকিউরিটিজ লি.’র নামে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক লি. পরিচালিত হিসাবে ৮ কোটি টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়, যা পরে জানতে পারেন উজ্জল। এ ছাড়া জবানবন্দিতে কীভাবে অন্য সব প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের অর্থ সরিয়ে নেওয়া হয় তার বর্ণনা দেন।

উজ্জল আরও জানান, পিকে হালদার বিভিন্ন সময় তাকে বিভিন্ন দেশে প্রমোদের জন্য পাঠাতেন। তিনি সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে গিয়েছেন দু-তিন বার। এসব ভ্রমণে তার সঙ্গী হতেন রাজীব সোম, অমিতাভ অধিকারী, অবন্তিকা বড়াল। সব খরচ বহন করতেন পিকে হালদার। পিকে হালদারের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিলেন অবন্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাই। অবন্তিকা ও রুনাই আলাদা আলাদাভাবে ২০-২৫ বার সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ভ্রমণ করেছেন পিকে হালদারের সঙ্গে। অবন্তিকা ও রুনাইয়ের মধ্যে ছিল পিকে হালদারকে নিয়ে চরম প্রতিযোগিতা। যদি পিকে হালদার গোপনে অবন্তিকাকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে ঘুরতে যান এটা যদি কোনোভাবে রুনাই জানতেন, তা হলে পিকে হালদারের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালাতেন নাহিদা রুনাই। একবার এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকে গিয়ে পিকে হালদারের সাথে নাহিদা রুনাই ঝগড়া করেন এবং রাতে পিকে হালদারের বাসায় গিয়ে তার রুম ভাঙচুর করেন। তাকে না জানিয়ে গোপনে অবন্তিকার সাথে মেলামেশা একদম সহ্য করতেন না নাহিদা রুনাই। গোপনে সংবাদ পেয়ে একবার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়ে পিকে হালদারকে ধরে ফেলে রুনাই এবং অবন্তিকার সাথে বিদেশে যেতে না দিয়ে ফেরত নিয়ে আসেন। ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে রুনাই ও অবন্তিকার সাথে পিকে হালদার আলাদা আলাদা সময় কাটাতেন এবং উপভোগ করতেন। রুনাই চালাতেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এবং অবন্তিকা পিপলস লিজিং।

সিমটেক্সের সিদ্দিকুর রহমান, জেডএ অ্যাপারেলসে মো. জাহাঙ্গীর আলম, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক শহীদ রেজা ছিলেন পিকে হালদারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এদের বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে প্রত্যেকেই উপকৃত হয়েছেন।

পিপলস লিজিংয়ে চেয়ারম্যান হওয়ার মতো যোগ্যতা প্রকৃতপক্ষে আমার নেই। পিকে হালদার আমাকে এ চেয়ারে বসিয়েছে এবং সবকিছু পরোক্ষভাবে পিকে হালদার নিয়ন্ত্রণ করতেন। আমাদের আগে চেয়ারম্যান ছিলেন ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম। তিনি চেয়ার ছাড়তে অস্বীকৃতি জানালে পিকে হালদার চেকের মাধ্যমে ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেমকে ১২ কোটি টাকা ঘুষ দেন। এর পর তিনি রাজি হন এবং আমাকে পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দেন।

প্রসঙ্গত, ৭০ কোটি ৮২ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে পিকে হালদারসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে গত ২৪ জানুয়ারি দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় ১-এ মামলাটি করেন উপপরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান। মামলা দায়েরের পর বিকালেই এ দুজনকে মৎস্য ভবন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে দুদক।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877